শিক্ষা নিয়ে কথা


মো: নুরুল আফছার

শিক্ষা হল আচরণগত পরিবর্তন। জ্ঞান লাভের পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া ও ব্যক্তির সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের অব্যাহত অনুশীলন। শিক্ষার মাধ্যমে শেখার সুবিধা বা জ্ঞান, দক্ষতা, মান, বিকাশ এবং অভ্যাস অর্জন করা যায়। শিক্ষা দেশ বা জাতিকে ভালবাসার প্রশিক্ষণ দেয়ার কৌশল। শিক্ষা এমন হওয়া উচিত যা জীবিকা উপার্জনের সহায়ক। একে বলা যায় বৃত্তিমূলক শিক্ষা। বুদ্ধির দিক দিয়ে যারা দুর্বল তারা বৃত্তিমূলক শিক্ষার মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস বাড়াতে পারে। আমাদের দেশে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে তাতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বেকার সৃষ্টি হচ্ছে।

একটা দেশের উন্নতির জন্য অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক্ষেত্রে অন্যান্য খাতের মত ফরেন রেমিটেন্স একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতিনিয়ত প্রচুর মানুষ বিদেশে যাচ্ছে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য। চাকরি এবং উচ্চ শিক্ষার জন্য প্রচুর লোক ইউরোপ ও আমেরিকায় গমন করছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যোগ্যতার সামান্য ঘাটতি থাকলেও নিজ নিজ দক্ষতায় সফলতা অর্জন করছে। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে যারা যাচ্ছে তাদের বেশির ভাগই কাঁচা হাতের হওয়ায় সেখানে তারা নিজেদের যোগ্য করে তুলতে পারছেনা। কারিগরি শিক্ষা নিয়ে তাদের খুব একটা বেশি যাওয়া হচ্ছেনা। যে জায়গা থেকে ডিফেন্স করে তারা নিজেদের যোগ্য করবে সেখানে বিশাল ঘাটতি।

আসুন মীসরাইয়ের প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে। প্রায় দুইশত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সরকারি পর্যায়ে প্রায় ৪৪ হাজার শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে। করোনা পরবর্তী এ সরকারি স্কুলগুলোতে ছাত্রছাত্রী হ্রাস পাচ্ছে। পাশাপাশি বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন স্কুল ও নূরানী মাদ্রাসায় ছাত্রছাত্রী বাড়ছে। সরকারি পর্যায়ে পর্যাপ্ত অবকাঠামো প্রশিক্ষিত শিক্ষক, অন্যদিকে বেসরকারি বা নূরানী মাদ্রাসার ক্ষেত্রে অবকাঠামো নেই বললেই চলে।

তাদের শিক্ষার ক্ষেত্রে এ ব্যবস্থা কেন? কারণগুলো হলো:-

১. বারবার সিলেবাস প্রণয়ন। ২. গ্রামীণ অনেক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক অপ্রতুল। ৩. ধর্মীয় ক্ষেত্রে সাংঘর্ষিক কিছু অপপ্রচার। ৪. এক শ্রেণির শিক্ষকের উদাসীনতা। ৫. একাডেমিক পড়ালেখার বাহিরে অন্যান্য ক্ষেত্রে সময় ব্যয়। ৬. মেধাবীদের মূল্যায়ন হচ্ছে না।

বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কিন্ডারগার্টেন এবং নূরানী মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী বৃদ্ধির কারণ:

১. প্রতিদিন ছাত্রছাত্রী থেকে পড়া আদায় করা। ২. ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়টা অধিকতর প্রাধান্য। ৩. ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক সমন্বয় অপেক্ষাকৃত বেশি। ৪. পুরো সময়টা একাডেমিক নির্ভরতা।

প্রাথমিক শিক্ষার এ প্রভাব মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং কলেজ পর্যায়েও পড়েছে। প্রতিনিয়ত কারিকুলাম পরিবর্তন এবং প্রজ্ঞাপনের উপর শিক্ষা ব্যবস্থা নির্ভরশীল। আমাদের দুর্ভাগ্য এ দেশে এখনও পর্যন্ত শিক্ষা আইন পাশ হতে পারেনি। অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবতা বিবর্জিত ‘নতুন কিছু কর’ – এ স্লোগানে চলছে শিক্ষা ব্যবস্থা। কারিগরি শিক্ষার কথা উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে তার ছিটে ফোঁটাও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আমাদের এ জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে বিশাল একটি জনগোষ্ঠী বেকার সমস্যায় ভুগছে। তারা জানেন না বা জানার চেষ্টা করছেনা তারা কি পড়বে। এদেশে শতাধিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আছে। হাতেগোনা কিছুর মান থাকলেও বেশির ভাগেরই মান নেই। শর্তের বেড়াজালে কিছুকিছু বিশ্ববিদ্যালয় টিকে থাকলেও এসব প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য শিক্ষার্থীর যেনতেনভাবে পাস যা মানহীন শিক্ষা ব্যবস্থায় আরেকটি বড় উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষা বিস্তারের কথা উল্লেখ থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষা সংকোচন নীতির পর্যায়ে পড়েছে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞানে পড়ে তাকে ব্যবসা বা মানবিকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হচ্ছে। এ দেশের সেরা ছাত্রছাত্রীদের উল্লেখযোগ্য অংশ ডাক্তার বা প্রকৌশলী। রাষ্ট্রের অনেক সুবিধা নিয়ে তারা এ পর্যায়ে এসেছে। ক্যাডার নামক চাকরির কারণে এবং বিশেষ কিছু ক্যাডারের অতিরিক্ত প্রভাব ও সুবিধার কারণে অনেক ডাক্তার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলী তাদের পেশা বাদ দিয়ে কিছু আকর্ষণীয় ক্যাডার তথা এডমিন, পুলিশ ক্যাডারে চলে আসছে। তাদের পুরো শিক্ষাটাই এক দিকের আর পেশাগত পদবীটা আরেক দিকের। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছুই নয়।

এদেশে প্রচুর মেগা প্রজেক্ট হচ্ছে। সেখানে অর্থের ন্যূনতম ঘাটতি নেই। যত ঘাটতি শিক্ষার ক্ষেত্রে। অংকের হিসেবে বাজেট বাড়লেও বাস্তবে শতকরা হিসেবে দিন দিন কমছে। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অনেক সুবিধা থাকলেও সার্বিক ক্ষেত্রে খুব একটা এগুতে পারেনি। শিক্ষা আইন না থাকায় প্রজ্ঞাপন নির্ভর হয়েছে আমাদের পড়ালেখা। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ৯০ ভাগ সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলেও সুবিধা নিচ্ছে অন্য পক্ষ। প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষা প্রশাসন সংক্রান্ত বিষয় একচেটিয়া সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা ভোগ করছে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নামমাত্র থাকলেও তা হিসেবের মধ্যে পড়েনা। বেসরকারি তথা এমপিও ভুক্ত শিক্ষকদের অবসরে কল্যাণ ভাতা ও অবসর ভাতা পাওয়ার ব্যাপারটা দীর্ঘসূত্রিতায় আবদ্ধ। দেড় বৎসর যায় কল্যাণ ভাতা এবং ৩-৪ বৎসর যায় অবসর ভাতা পেতে। সরকার এক্ষেত্রে থোক বরাদ্ধ দেওয়ার ব্যাপারটা আমলে নিচ্ছেনা। যত অভাব বেসরকারি শিক্ষাক্ষেত্রে। এভাবে দেশের একটা বিশাল জনগোষ্ঠিকে পাশ কাটিয়ে কোন অবস্থার উন্নতি সম্ভব নহে। গাছ কেটে আগাছা পরিষ্কার করে তো লাভ হবেনা।

আগে শিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন দাবি নিয়ে যুক্তিসংগত আন্দোলন হত। এক সময়ে সরকারি দলীয় শিক্ষক-কর্মচারী সংগঠন ছিলনা। পেশাদারিত্ব বাদ দিয়ে রাজনৈতিক লোক লাগিয়ে এ জাতীয় সংগঠনের কার্যক্রম বৃদ্ধি হলেও শিক্ষক-কর্মচারীদের কোন উপকার হচ্ছেনা। ব্যক্তি স্বার্থকে প্রাধ্যন্য দিয়ে নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত। শিক্ষক-কর্মচারী সংগঠনগুলো ত্রিধাবিভক্ত। প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হত্যা থেকে আরম্ভ করে কানটেনে উঠবস করালেও শিক্ষক সংগঠনগুলোর তেমন প্রতিক্রিয়া নেই। শুধুমাত্র সরকার দলীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বর্গ নিয়ে সভা-সমাবেশে ব্যস্ত। এটাও সত্য যে, এক শ্রেণির শিক্ষক তাদের পেশাদারিত্ব হারিয়ে হেন কোন অপকর্ম নেই যা তারা করছেনা।

বড় বড় নামকরা স্কুলের শিক্ষার্থীরা বিদ্যার চাইতে অহংকারী হয় বেশি। সার্টিফিকেট বাড়ছে মানেই এই নয় যে দেশ ভারমুক্ত হচ্ছে। সার্টিফিকেট বাড়া মানে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাটাও ভারী হচ্ছে। যে দেশে প্রাইমারি শিক্ষকের বেতন একজন দারোয়ানের সমান সেখানে তাদের সঙ্গে দারোয়ানের মতোই আচরণ করবে। তখন তাদের সঙ্গে দারোয়ানের মত আচরণ করেন। শিক্ষার্থীরারও দারোয়ানের মনোবৃত্তি সম্পন্ন হবে। হুমায়ুন আহমেদ এর ভাষায়, ‘অনার্স শ্রেণিতেই এখন পিএইচডি কোর্স চালু করা সম্ভব’। এতে ছাত্ররা খুব কম সময়ে ডক্টরেট ডিগ্রি পেতে পারে। এখনকার অধিকাংশ ডক্টরেটই স্নাতক পূর্ব ডক্টরেট, অদূর ভবিষ্যতে উচ্চ-মাধ্যমিক ডক্টরেটও পাওয়া যাবে। ক্যাডার সাধারণত দুই প্রকার অস্ত্রধারী ও কলমধারী। কেউ ফাইল আটকে রেখে অর্থ আদায় করে আবার কেউ অস্ত্র মাথায় ঠেকিয়ে অর্থ আদায় করে। কিন্তু বাস্তবে কলমধারীরাই অস্ত্রধারীদের গালি দেয়। শিক্ষার উন্নতির জন্য শর্ট-কার্ট মেথড বাদ দিয়ে যুক্তিসংগত এবং বাস্তবতার নিরিখে আমাদের এগোতে হবে। এতেই জাতি উন্নত হবে।

লেখক : অধ্যক্ষ, মীরসরাই কলেজ, চট্টগ্রাম।