মাহমুদ নজরুল
মার্বেল খেলার বয়সে যা কিছু দেখেছি বা শুনেছি এখন তা বিস্ময়কর মনে হয়। কখনো কখনো নস্টালজিয়ায় আত্মসমর্পণ করি। বাল্যবেলায় বৈশাখের যে উন্মাদনা দেখেছি, যে উৎসব প্রতিটি মানুষের হৃদয় উৎসাহিত করে দিতো, এখন তার ছিটে ফোটাও দেখা যায় না। ভাবতাম কখন বৈশাখ আসবে, নববর্ষের ছোঁয়া পাবো, মেলায় যাবো, আনন্দ করবো। বন্ধুদের নিয়ে ঘুরে ঘুরে ফুল তুলবো। এ’পাড়া, ও’পাড়ায় বনভোজন করে বেড়াবো। সেটা আর এখন নেই বললেই চলে। মনে পড়ে সেই ছোট্ট সকালের মেলায় যাবার প্রস্তুতি, কারা কারা যাবে একসাথে বসে ঠিক করা, এসব এখন স্বপ্ন।
মনে পড়ে, বৈশাখে পাড়ায় পাড়ায় বলি খেলা হতো। ছোট বলি, মেঝো বলি, বড় বলি। সে-কী আনন্দ! বালি ফেলে জমিতে বলি খেলার জন্য প্রস্তুত করা হতো। সেই বলি বা কুস্তি খেলার জন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে দল বেঁধে বলিরা আসতেন। সাথে সমর্থক নিয়ে আসতেন। বিভিন্ন বিভাগে আবার বিজয়ী বলিদেরকে পুরস্কার দেয়া হতো। হাত ঘড়ি, রেডিও, টেলিভিশন, পাখা, দেয়াল ঘড়ি ইত্যাদি ছিল পুরস্কার। সেই বলি খেলাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পণ্যদ্রব্যের মেলা বসত। প্রচুর বেচাকেনা হতো। প্লাস্টিকের পুতুল, মাটির পুতুল, আংটি, ঘড়ি, দুল, কাগজের ফুল ইত্যাদি নানান জিনিস কম দামে বিক্রি হতো মেলায়। আমরা কিন্তু এসব কিনতেই মেলায় যেতাম। বাল্য বয়সের ছেলেদের প্রধান আকর্ষণ ছিল হরেক রকমের পণ্যসামগ্রী।
পয়লা বৈশাখ থেকে ৬ বৈশাখ পর্যন্ত এসব মেলা হলো। মাঝে মাঝে পুরো বৈশাখ মাস জুড়ে হতো। এসব মেলাকে গডিয়া বলা হতো। মুহুরী নদীর পাড়ে বারোনি স্নানে যেত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা। তাদের সাথে আমরাও যেতাম ধুমঘাট ব্রিজের কাছে। সেখানেও হরেক রকমের পণ্যসামগ্রী বিক্রি হতো। বাঁশি কিনে বাহিরে বাজিয়ে দল বেঁধে বাড়ি ফিরতাম। সে কি আনন্দ! এলাকায় সবচেয়ে বড় মেলা হতো ইছামতিতে। সেখানে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোক সমাগম হতো। সবচেয়ে বড় কথা তখন প্রচার করার জন্য তেমন মাইকের ব্যবস্থা ছিল না। বাজারে বাজারে কেরোসিন তেলের খালি টিনে লাঠি দিয়ে আঘাত করে ঘোষণা করা হতো। এভাবে প্রতিটি বাজারে ঘোষণা করার জন্য কিছু লোক নিয়োগ দেয়া হতো।
নববর্ষের আগে পরে কোকিল ডাকা বিকেলে ঘুড়ি ওড়ানোর ধুম লেগে যেত পাড়ায় পাড়ায়। ঘুটঘটে অন্ধকার কাটিয়ে যখন পূর্ণিমার রাত হতো জমিতে জমিতে দাগ কেটে দাড়িয়াবান্ধা বা সৈর খেলা হতো। গ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই মিলে প্রায় প্রতিটি জ্যোৎস্না রাতে সৈর খেলা খেলতো। আর এখন রাতে খেলা হয় বৈদ্যুতিক আলো জ্বালিয়ে ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট, ভলিবল।
নববর্ষের আগে পরে গ্রামে গ্রামে যাত্রা হতো। নাটক হতো, পুথিঁ পাঠের আসর বসত। এখন সেটা কল্পনার বাইরে। নববর্ষকে উপলক্ষ করে বাজারের সওদাগরেরা হালখাতা পালন করতেন। দোকানকে সাজানো হতো। কলাগাছ দিয়ে গেইট দেয়া হতো। লাল নীল কাগজ কেটে রশি বেঁধে সাজানো হতো দোকান। যাদের কাছে বাকি-বকেয়া ছিল তাদেরকে চিঠি দিয়ে দাওয়াত দেওয়া হতো। পুরোনো খাতা বাদ দিয়ে নতুন হিসাব খোলার খাতাকে হালখাতা বলা হতো। মিষ্টি খাইয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে বকেয়া সংগ্রহ করা হতো।
সেই সব দিনগুলো আজ আর নেই। এখন পান্তা ইলিশের মত বিলাসবহুল কার্যক্রমে বৈশাখকে কৃত্তিমতায় জড়িয়ে ফেলা হয়েছে।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক